শেষ যাত্রা
স্বাধীন আচার্য
বাসের সিটটা খালি হওয়া মাত্রই মম বসে গেল। ঐদিকে সদাফ এখনো দাড়িয়ে আছে। চলন্ত বাস।সাদাফের পৃথিবী এখন দুলছে। মোশন সিকনেস। এখন সাদাফ কে দেখলে মনে হবে সে হিংসায় মারা যাচ্ছে। সে মমর দিকে কড়া চোখে তাকালো। যেন পৃথিবীর যাবতীয় সুখ সব ওই বাসের সিটেই আছে। মমর মুখ অবশ্য হাসি হাসি। সে বাসের সিটে সিংহাসনের মতো করে বসেছে। হাতে কাল্পনিক সিগারেট। সিগারেটের ধোঁয়া সে সাদাফের মুখের দিকে ছাড়ছে। হঠাৎ সাদাফ রেগে গেল, "উফ! মম হচ্ছে টা কি? বন্ধ কর" মম কিছুই বললো না,তার সাদাফ জ্বালাতে অতিরিক্ত ভালো লাগে। তীব্র গতিতে বাস ছুটছে। সাদাফরা যখন বাসে উঠেছিলো তখন সবাই ঘুম। এখনো বেশি কেউ জেগে নেই। অথচ, বিকাল ৫ টা বাজে মাত্র। বাসের ড্রাইভার, মানেক। আজ, তার মন খারাপ৷ আজকে তার স্ত্রী ইয়াশার জন্মদিন। তার খুব ইচ্ছা ছিল আজকের দিনটা ইয়াশার সাথে কাটাবে। কিন্তু ছুটিই পেল না। আজ সে তার সব রাগ বাসের স্টিয়ারিং উইল এর উপর ঝাড়ছে। কে জানে কি হয়! সাদাফের ফোন বেজেই চলেছে। "হ্যালো, আম্মু এইতো আর ১ঘন্টা" "আচ্ছা, আম্মু সাবধানে থাকব" প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ফোনটা কাটে সাদাফ। "আম্মুর জ্বালা কোথাও বের হওয়া যায় না, খালি ফোন, ফোন আর ফোন। ধ্যাৎ ভাল্লাগে না " ফোনটা সুইচ অফ করে দেয় সাদাফ। মম সিটে ঘুমাচ্ছে। মমকে খোঁচা দিয়ে তুলে দেয়। মম বিরক্ত চোখে সাদাফের দিকে তাকালো। "কি? ঘুমন্ত মানুষকে তুলে দেওয়া কত বড় অপরাধ জানিস না?" "ফোনটা রাখতো " "এটার জন্য তুলে দিলি! আচ্ছা দে" সাদাফ হেসে উঠলো। মমকে বিরক্ত হলেও যা সুন্দর লাগে! বাস চলছে,একবার অবশ্য থেমেছিল। তবে অল্প সময়ের জন্যই। অনেকেই জেগে উঠেছে। মম অবশ্য এখনো ঘুম। হঠাৎ একজন সিট ছেড়ে দিলো। নেমে যাবে। বেশ কিছুটা দূরে হলেও মোটামুটি যুদ্ধ করেই সিটটা দখল করে ফেললো সাদাফ। বসেই শান্তি। সারা শরীর জুড়ে আলস্য ছড়িয়ে পড়লো। সাদাফ ঘুমিয়েই যাচ্ছিলো। হঠাৎ মনে পড়লো আজকে সাদিকের জন্মদিন। ওরা বন্ধু,পরিচয় বেশিদিনের না। কিন্তু ঘনিষ্ঠতা ভালোই। "সাদিককে উইশ না করলে, পুরো বছর জ্বালাবে গাধাটা" কিন্তু ফোন তো মমর কাছে। সিট ছাড়ার ইচ্ছে ও নেই। সিংহাসন বেদখল হবে নিশ্চিত। কি করা যায়? "মম" " এই-মম " "ম-ম" মম শুনছে না। একে ওর সিট অনেক দূরে।তার উপর গাড়ির প্রচন্ড শব্দ। পাশের জন ও কিছুই শোনার কথা না। কি করা যায়? হঠাৎ, গাড়ির গতি সামান্য কমলো। সাদাফ পিছন থেকে পানির বোতলের ঢাকনা মমর চাঁদি লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলো। "বুলস আই!!!!!" "উফ!বিরক্ত করিস কেন? তোকে না বলেসিবিরক্ত না করতে " চেচিয়ে উঠে মম। সবাই এখন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে । সাদাফ বলে "আরেহ, আমার ফো...... সাদাফের কথা শেষ হয় না। একটা অচেনা কন্ঠ বলে উঠে " ছেলেটা আপনাকে বিরক্ত করছে আপা?" আরেকজন বলে উঠে "অবশ্যই করছে, চেহারা দেখেই বোঝা যায় তাফালিং পোলা" মম দ্রুত কি একটা বলার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু সবাই প্রচন্ড জোরে চিৎকার করতে থাকে। কিছু বোঝার আগেই ১ম লোক টা সাদাফকে মেরে বসে। মারের চোটে সিট থেকে পড়ে যায় সাদাফ। ঠিক তখনই ২য় লোকটা সাদাফের পেটে লাথি মারে। প্রচন্ড শোরগোল। চারিদিকে খালি কুৎসিত সব গালাগাল। মম কেন জানি চিৎকার করছিলো। কিন্ত কেউ তার কথায় গুরুত্ব দিলো না। সবাই সাদাফকে মারছে। সাদাফ কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছে না। স্রেফ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। একবার জানি কি বলার চেষ্টা করেছিল একজনের পা তার ঠোঁট থেঁতলে দেয়। বাস থেমে গেল। সবাই মমর তীক্ষ্ণ চিৎকারে শান্ত হয়। মম সবাইকে ঠেলে সাদাফের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। সাদাফের প্রাণহীন দেহটা পাওয়া গেল কিছুক্ষনেই। মুখ ফেটে গেছে, গায়ের শার্ট টা ছিঁড়ে গেছে। এই শার্ট টা সে জন্মদিনে সাদাফকে হাতখরচের টাকা জমিয়ে দিয়েছিলো। মমর ভেতরটা হঠাৎ শূন্য হয়ে গেল। কোন কষ্ট নেই,দুঃখ নেই। স্রেফ বিষ্ময় আর শূন্যতা। ফোনের শব্দে মমর ঘোর কাটে। কে সেটা না দেখেই রিসিভ করে মম। "হ্যালো, মম মারে তোরা পৌছাইসোস?" মায়ের গলা শুনে হঠাৎ কেঁদে উঠে মম, "হ্যালো মম, কি হলো মা!কি হলো কান্না করিস কেন?" মম কান্না চেপে অনেক কষ্টে বলে "আম্মু,ভাইয়া মারা গেছে.....
স্বাধীন আচার্য
পাথর ঘাটা,চট্টগ্রাম ২৯.৯.২০২০