নব রুপে ভালোবাসা


                       নম্রতা চন্দ

                  নব রুপে ভালোবাসা

অনিমেষ বাবু ঘরে ঢুকে নাইট বাল্বটা অফ করলেন তারপর বিছানার পাশে এসে ভাঁজ করা চাদরটা স্ত্রীর গায়ে দিয়ে বললেন, 

'তমা,আজ ছাদে যাবে? কতদিন একসাথে চাঁদ দেখিনা বলো তো?'

ঘুমজড়ানো সুরে তমা দেবী বলে উঠলেন, 'আরে কর্তা, এই ব্যাথা পা নিয়ে ছাদে যাবার বয়স আর কি আছে? এই রাতদুপুরে তোমার এমন শখের কারণ বুঝি না বাপু।'

 'আচ্ছা,যদি আমি তোমাকে কোলে করে নিয়ে যায় এই ধরো, ঠিক সিনেমার মতো করে তোমায় কোলে নিয়ে এক একটা ধাপ ভেঙে ছাদে উঠছি......' 

' আমাকে মানে! ওসব আবদার করো না একদম, আমি চাই না যে, এই সত্তর বছর বয়সে এসে কোমরটা ভাঙুক আর কি। আর এই বয়সে এখনো ভালোবাসা জাগে বুঝি?অভিযোগের সুরে বলে উঠলেন তমা দেবী।

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অনিমেষ বাবু বললেন, ''আরে গিন্নি, ভালোবাসার আবার বয়স হয় নাকি? ভালোবাসার বিস্তার হয় না,

ভালোবাসার কোনো বয়স হয় না, 

আবার ভালোবাসার জন্য নির্দিষ্ট করে সময়ও লাগে না। 

দেখোই না,যদি ভালোবাসার সময়খানা বাঁধা থাকতো তাহলে আমরা পঞ্চাশটা বছর একসঙ্গে থাকতে পারতাম কখনো? 

মুচকি হেসে তমা দেবী বিছানাতে চাদরটা পাঠ করতে করতে বললেন, 'আচ্ছা আচ্ছা, হয়েছে, আমি যাচ্ছি, দাও লাঠিটা দাও'।

তারপর তমা দেবী লাঠির ওপর ভর করে একটা একটা করে সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে অনিমেষ বাবুর সাথে ছাদে গেলেন, মাদুরখানি পেতে অনিমেষ বাবুর কোলে মাথা রাখলেন। 

'আচ্ছা তমা, তোমার আর আমাকে নিজের করে পেতে ইচ্ছে করে না বলো?'

একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে তমা দেবী বললেন, ' বলো তো কর্তা, পর তোমায় কবে করেছি?সেই আলাপের প্রথম দিন থেকেই তো তোমাকে আপন করেছি।' 

একনাগাড়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তমা দেবীর কাশিটা বড্ড বাড়তেই অনিমেষ বাবু ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,

' উফফ এত কথা বলো না তমা, তোমার কাশি বাড়বে, কষ্ট হবে। 

 'আরে কর্তা ,আজ আমাকে বলতে দাও তাতে নাহয় একটু কষ্ট হবে। জানো এই স্তব্ধ রাত্রির প্রতিটা মুহূর্ত জানে তুমি হৃদয়ের কতটা কাছে আছো ।'

কথার মাঝেই অনিমেষ বাবু হাসি হাসি মুখ করে বলে উঠলেন, 'আর আমার প্রথম চিঠি। ওটার কথা মনে আছে?' 

'সেটা কি করে ভুলে যায় বলো তো। তোমার চিঠির প্রথমে লেখা ছিল চন্ডীদাসের লাইন,—

         " এমন পিরীতি কভু নাহি দেখি শুনি।

          পরাণে পরাণে বান্ধা আপনা আপনি।।

           দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।

           আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া।।"

হাসি মুখে অনিমেষ বাবু স্ত্রীর হাত ধরে বলে উঠলেন, 'তমা আমাদের এই শেষের দিনগুলোতো আরো একবার অতীতে ফেরা যায় না ? চলোই না , কালকের দিনটা এই জীবনস্রোতের নৌকার পথকে ঘুরিয়ে আবারো উৎসের দিকে ফিরে যাই।

আরো একবার হাতে হাত রেখে কলকাতা,আরো একবার গঙ্গার ঘাট আর যা কিছু ছিল সব... ।কালকের দিনটা শুধুমাত্র আমাদের জন্যই শুরু হোক।'

চাঁদ তখন তার সমস্ত সৌন্দর্যের বহড়া সাজিয়ে আকাশকে সাক্ষী রেখে বৃদ্ধ দম্পতির স্মৃতিচারণের ব্যস্ততায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। অনেক বার্তালাপ, স্মৃতিচারণের পর শেষ পর্যন্ত গভীর শান্তিতে দুজনেই ঘুমের দেশে রূপকথার স্বপ্নে পাড়ি দিয়েছে। 

পরের দিন  সূর্য  তখন সমস্ত অন্ধকার কাটিয়ে আকাশের অনেক ওপরে ,যেন প্রত্যেকটি রৌদ্র কণা সূচনা করছে এক নতুন বার্তার। তমা দেবী আটপৌরে শাড়ি ছেড়ে আজ পরেছে লাল পাড়ের একটা ঢাকাই জামদানি। অনিমেষ বাবুর পরনেও ধুতি লুপ্ত হয়ে শার্ট, প্যান্ট এসেছে, হাতে স্ত্রীর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া পুরোনো ঘড়ি যদিও ওটা এখন আর চলে না তবুও স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো এই ঘড়ি একটা মাহাত্ম্য বহন করে ওনার কাছে। 

অনিমেষ বাবু একদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। যৌবনের ফেলে আসা দিনগুলোর নতুনত্বের  রুপ নিয়ে আজ যেন শুরু হতে চলেছে এক পরিপূর্ণ অধ্যায়। তমা দেবীকে দেখে যেন ওনার মনে হচ্ছে স্বয়ং বিশ্বকর্মা তাকে সদ্য সুনিপুণ ভাবে নির্মাণ করেছেন। আজকের সকালটা যেন সমস্ত বর্তমানকে ছিন্নভিন্ন করে সুমধুর অতীতে ফিরে গেছে। 

বৃদ্ধ দম্পতি দুজনে হাতে হাত রেখে বেরিয়ে পড়লেন যৌবনের সেই কলকাতার অলিগলিতে নিজেদের অতীতকে ফিরে পেতে। আরো একবার হাওড়া ব্রিজ,ভিক্টোরিয়া, আরো একবার ভাঁড়ের চা, আরো একবার গঙ্গার ঘাটের উষ্ণ চুম্বন। দুজন দুজনের হাত শক্ত করে চেপে ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কলকাতার অলিগলি, নতুন ভাবে আবিষ্কার করছে একে অপরকে। 

সূর্য তখন তার শেষ আলোটুকু নিশ্চিহ্ন করে পশ্চিমের আকাশে ডুব দিয়েছে,গঙ্গার ঘাটে বসে আছে অনমিষবাবু আর সঙ্গে স্ত্রী তমা। 

হঠাৎ অনিমেষ বাবু বলে উঠলেন, 'এখনো কি ভালোবাসি বলা যায় না? আজ পর্যন্ত তো কোনোদিন মুখফুটে ভালোবাসি কথাটা বলোনি তুমি।'

তমা দেবী গঙ্গার ঘাটে ভেসে থাকা নৌকোগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ' আমি তো তোমার সাথে শুধু মাত্র বৃদ্ধ হতেই চেয়েছিলাম, আর যদি বলি ভালোবাসি না, কোনোদিন ই তোমায় ভালোবাসতে পারিনি তবে.. '

'তবে এতগুলো বছর একসাথে থেকেছো কেন বলতে পারো? কেবলমাত্র একসাথে বৃদ্ধ হবার জন্য?ভালোবাসার কিন্ত আমি অনেক উদাহরণ দিতে পারি, এই যে আমি মাছ খাওয়ার পর বাকি শেষ  অংশটুকু খাওয়ার অভ্যাসটা তাহলে তোমার নিছকই হ্যাংলামো? আমার শার্ট,আমার ভেজা চুলের গন্ধ এগুলো কি সব তোমার বদ অভ্যাস? আমার রাগ, অনুরাগ, অভিমানের সঙ্গিনী কে আমি তো অভিনেত্রী ভাবতে পারি না তাই না? ভালোবাসা না থাকলে আমরা বোধহয় একসাথে বৃদ্ধ হতে পারতাম না । আসলে কি জানো আমাদের সম্পর্কটাতে ভালোবাসি শব্দটার ব্যবহার না হলেও আমরা পরস্পর ভালোবাসায় আবদ্ধ। আসলে কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যেখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না তবুও হাজার হাজার বছর একসাথে কাটানো যায়। রাগে থাকা যায়, অভিমানে আগলে রাখা যায়, শাসনেও ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায়।' 

গঙ্গার ঘাটে চারিদিকে তখন মানুষের ভিড়, অনিমেষ বাবু আস্তে আস্তে তমা দেবীর দিকে এগিয়ে এলেন। 

" আরে কর্তা, এখানে কত মানুষ... " মুখ চেপে ধরলেন অনিমেষ বাবু তারপর বলে উঠলেন, 

"উঁহু ....কর্তা না, অনি বলো, কতদিন ওই নাম ধরে তুমি আমাকে ডাকোনি বলো তো। "

তারপর দুজনে ডুব দিল এক উষ্ণ চুম্বনের গভীরে। গঙ্গার ঘাট যেন ফিরে পেয়েছে পঞ্চাশ বছর আগের সদ্য যৌবনে উপস্থিত কলেজ পালানো প্রেমিক প্রেমিকাকে।  চারপাশের মানুষের কাছে থেকে ভেসে আসছে নানা গুঞ্জন ।কেউ কেউ বলেই ফেলছে. 

"এই বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে নাকি"। 

কেউ আবার ওদের দেখে তার প্রেমিকের হাত শক্ত করে ধরে অনেক বছর একসাথে থাকার স্বপ্ন দেখছে। আবার কেউ তার ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের ফাটলে একটু একটু করে জোড়াতালি দেবার  চিন্তায় ডুব দিয়েছে।  

এই বৃদ্ধ দম্পতির ভালোবাসার কথা,মূহূর্তগুলোর কথা ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতার নানা পথে ঘাটে। ওরা দুজনেই চাই ওদের পথটা যেন শেষ না হয়, এক অফুরন্ত সময়ের যাত্রী হয়েই ওরা বাঁচতে চাই। 

আসলে ভালোবাসা হল অফুরন্ত। ভালোবাসা কখনো  পুরোনো হয় না ,কেবল মানুষের সময়গুলো পুরানো হয়ে পড়ে। ভালোবাসা বার বার নব নব রুপে ধরা দেয় ভালোবাসার মানুষদের কাছে। 

Blogger দ্বারা পরিচালিত.