বেনু পিসি ॥
অজয় শীল
পুজো এলেই কেমন যেন একটা কষ্ট চেপে বসে বুকের মধ্যিখানে, বোঝাতে পারিনা , কিসের কষ্ট ! বুঝতেই কি পারি ঠিক করে ? যেই ছাতিম ফুলের গন্ধ এলো নাকে ওমনি যেন কোথাও একটা বিষাদ সুর বেজে ওঠে । আলোর বেণু বাজে , আর ভিতর পুরে কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে যায় ! এ অসুখ যে আমার কতদিনের, এখন আর মনে পড়ে না !
ছোটবেলায় যেখানে থাকতাম সেই রেল কোয়ার্টারের সামনে ছিলো মস্ত এক মাঠ , তার অদ্ধেক জুড়ে চলত ফুটবল । আর শরৎ এলেই মাঠের দখল নিত কাশবন!
হঠাৎ করে বেলা ছোট হয়ে আসছে ,সন্ধ্যা নামছে দ্রুত ,বেণু পিসি ডাকত , বাবুন রাত হয়েছে বাড়ি এসো ! অথচ তখন সবে সন্ধ্যা ! একে একে বাড়ি ফিরতাম সকলে ।
এইসব সন্ধ্যেয় পড়তে বসার চাপ কমে আসছে ! আমরা কোয়ার্টারের বারান্দায় বসতাম বটে বই নিয়ে, তবে একটু পরেই পড়াশোনা শিকেয় উঠত, দুই দিদির ফিসফিস শুরু হত , পিসি মৃদু বকুনি দিত দু একবার তারপর নিজেই যোগ দিত দিদিদের গল্পে, আমি শ্রোতা ! ভিতর থেকে ভেসে আসছে রেডিওর আওয়াজ , বাবা খবর শুনছেন । একটু পরে মাও এসে বসেছেন বারান্দায়। খালি গলায় হঠাৎ শুরু হত গান , মা গাইতেন , বাঁশ বাগানের মাথার উপর , সেখান থেকে ভাসতে ভাসতে চলে যেত, ' নয়ন ভরা জল ' হয়ে ' প্রভু তোমা লাগি ' তে ! ছোড়দি , পিসি , মা সবাই ফিরে ফিরে গায় , কোয়ার্টারের বারান্দা ছাড়িয়ে রাস্তা , মাঠ , কাশবন পেরিয়ে সেই গান যে কোথায় হারিয়ে যেত ! আর সেই বিষন্নতা আমরা উপভোগ করতাম! বড্ড মন কেমন করত , অথচ মেদুর এক ভালোবাসা ঝিরি ঝিরি হাওয়ার মত পরশ দিয়ে যেত , কোথায় ? বুঝতে পারতাম না ।
বেণুপিসির বাড়ি জলপাইগুড়ি, বাবার জেঠতুতো বোন ! আমি যখন আরো ছোট বাবা একদিন ছোট্টখাট সদ্য কলেজে ঢোকা পিসিকে নিয়ে এলেন, আর সেইথেকে পিসি আমাদের সঙ্গে। এখানেই কলেজে ভর্তি হলো , পাশ ও করে গেছে বিএ ততদিনে !
একটু একটু করে জেনেছি , সুরজিৎ নামের এক মেধাবি ছেলের কথা , যার হাত ধরে বনানীর অঙ্গীকার ছিলো চিরদিন একসঙ্গে থাকার , সেই সুরজিৎদা কে একদিন নদীর ধারে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। দিনবদলের স্বপ্ন দেখা অনেক যুবকের সেদিন পরিণতি ছিলো এই রকমই। সেই সময় পুলিশের টানাটানি এড়াতেই নকশাল প্রেমিকা বনানীকে বাবা জলপাইগুড়ি থেকে জোর করে নিয়ে আসেন খড়্গপুরে ! পিসি কিছুতেই নাকি আসতে চায় নি।এসব কথা একটু বড় হয়ে জেনেছি, ততদিনে তিনি আমাদের বেনুপিসি রূপে এ সংসারে অধিষ্ঠিত।
বাবা মা দুজনেই প্রথম প্রথম পিসিকে বিয়ের কথা বলতেন, কিন্তু পিসির জেদের কাছে হার মেনে ততদিনে চেষ্টা ছেড়েছেন। আর একটু বড় হয়েছি , নাইন টেন হবে,পুজোয় তখনো কারোর জন্য এক সেটের বেশি জামা কাপড় হত না। পিসি টিউশনির পয়সা জমিয়ে আমাকে কিনে দিত একটা শার্ট , দিদিদের বরাদ্দ ছিলো চুড়ি, মালা, মাকে কিনে দিত একটা সেন্টের শিশি , কান্তা সেন্ট ! সপ্তমীর সকালে আমি পড়তাম পিসির দেয়া জামা , দিদিরা পড়ত গতবছরের ভালো কিছু। নতুন যা তা ত পড়া হবে অষ্টমীতে , চলবে তিনদিন , অষ্টমী , নবমী , দশমী।
প্রতিবছর একটা মজা হত অষ্টমীর সন্ধ্যায় , পিসি কিছুতেই নতুন শাড়ি পড়বে না। ঠাকুর দেখতেও বেরোবে না ! ধনুর্ভাঙ্গা পণ। মা ও ছাড়বে না , কিন্তু মাকে রণে ভঙ্গ দিতে হত। সংসারে সব ব্যপারে বউদিকে মেনে চলা তরুণী ননদিনি আজ অবাধ্য। অবশেষে আসরে নামত দুই দিদি ,তারা শুরু করত অনুনয় বিনয়। এমন কি নিজেদের সদ্য পড়া জামা , জুতো খুলে ফেলার হুমকি দিত। এই সময় মা একটু আড়ালে ডেকে নিতেন আমাকে , আমার হাতে পিসির জন্য কেনা শাড়িটা দিয়ে বলতেন , ' বাবুন তুই গিয়ে শাড়িটা দিয়ে বল তুমি না গেলে আমিও যাব না।' আমি ভয়ে ভয়ে যেতাম পিসির কাছে , কেন না আমার ব্যর্থতা মানে সব মাটি ! রাগ ও হত , পিসির উপরে মায়েদের উপরে, এত জোর করার কোন কারণ খুঁজে পেতাম না আমি। তবু গিয়ে বলতাম, ' পিসি নাও না পরে , সবাই যখন বলছে এত করে', বরফ গলত , পিসি গজগজ করতে করতে উঠে যেত ,' এটা তোমার বাড়াবাড়ি বউদি , ছোট বাচ্চাটাকে এসবের মধ্যে টেনে আনো কেন বুঝিনা।' মা মুচকি হাসে পিসিকে লুকিয়ে ! আর আমার একটু রাগ হয় , পড়ি ক্লাস নাইনে তবু আমাকে বাচ্চা বলা!
যদিও একটু দেরি হয় তবু আমরা অবশেষে পথে , বাবা ঘরে।
তারপর ঘোরাঘুরি শেষে এটা সেটা গিলে ঘরে ফিরেই শয়নে , মা আর পিসি বাবাকে কিছু খেতে দিয়ে কখন যে শুতে আসত আমি জানতেও পারতাম না।
সেইসব রাত্তিরে কে যে কোথায় ঘুমাত কোনো ঠিক থাকত না। এক মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়,দেখি বেনুপিসি ঘুমোচ্ছে অঘোরে, আমার পাশটিতেই , কখন শুয়েছে কে জানে । জানালা দিয়ে অল্প চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে , কেমন অপার্থিব লাগে ! বাঁধ ভাঙা যৌবন অনর্গল, বেখেয়াল, ঘুমন্ত তরুণীকে কি এক অবর্ণনীয়তায় স্থাপন করেছে , মৃদু আলো , হিমেল হাওয়া, আর দূর থেকে ভেসে আসা ছাতিম ফুলের গন্ধ সব কিছু এলোমেলো করে দেয়। আমি তাকিয়ে থাকি সেই স্খলিত , কিছু অনাবৃত রত্নমণি দুটির দিকে। শিরশিরিয়ে ওঠে শরীর, গলা শুকিয়ে কাঠ , অথচ উঠে বসতেও যেন পারিনা , নিঃশ্বাস বন্ধ করে পরে থাকি ,কতক্ষণ ? কে জানে ? হঠাৎ পিসির ঘুম ভেঙ্গে যায় , দ্রুত উঠে বসে , আমি ভয় পেয়ে যাই , নিজেকে মুহূর্তে গুছিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করে , ' ঘুমাস নি বাবুন? '
গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না। একটু এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রাখে বেনু পিসি। ' কি হল , ঘুম আসছে না ? '
কোনোরকমে স্বর বের হয় , ' না '
' আচ্ছা , তুই শুয়ে থাক , আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই , ঠিক ঘুম এসে যাবে।'
হাত বুলাতে থাকে বেনু পিসি, আমি কিছু স্থিরতায় ফিরি, বলি 'তুমি ঘুমাও পিসি, আমি ঠিক ঘুমিয়ে পড়ব।'
' আচ্ছা ঠিক আছে, ' পিসির হাত তবু থামে না।
আর তখুনি শুনি কি অদ্ভুত এক সুরে পিসি বলে ওঠে, 'তোরা আমাকে বড্ড জ্বালাস বাবুন' , বুঝতে পারিনা , শুধু শুনি, ' আসলে সুরজিৎ টা কিচ্ছু পেল না , আমি কেন সব পেয়ে যাব , এমনিই , কেন এমন করে ভরিয়ে দিস তোরা আমায় , ভরিয়ে রাখিস ? ' ভেসে যায় কথাগুলি , ধুয়ে যায় , নিজেকে ধরে রাখতে পারে না বেনু পিসি , ভেঙ্গে চুরে পড়ে ! সাক্ষী শুধু আমি , দিদিরা অঘোরে ঘুমোচ্ছে । তখন নবমীর ভোর হচ্ছে ,অস্ফুটে গান বাজে কানে , কাশের বনের উপর দিয়ে ছাতিমগন্ধ নিয়ে বয়ে যায় , ' যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু এবার এ জীবনে , তবে তোমায় আমি পাই নি যেন সে কথা রয় মনে । যেন ভুলে না যাই , বেদনা পাই শয়নে স্বপনে ...........'
পুজো আসে যায় , মন খারাপের অসুখ আমার সারে না ।