গল্পের শিরোনামঃ ফিরে যেতে হয় তোমাতে বারে বারে
কলমে: দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
চাকরিতে প্রমোশন ম্যানেজার পদে।বালি থেকে একদম মেদিনীপুরের ঘাটাল। আর্থিক উন্নতি হলেও শারীরিক অবনতি নিশ্চিত,কদিন যাতায়াতেই বুঝেছে সুমন। প্রায় দুশো কুড়ি কিলোমিটার যাতায়াত প্রতিদিন। শরীরে ঘুণ ধরতে বাধ্য।তার ওপর বড়ো অফিস। ব্যস্ততা তুঙ্গে সর্বদা। দিনের শেষে শরীরটাকে শুধু টেনে হিঁচড়ে নিয়ে ফেরা বাড়ির উদ্দেশ্যে।সকলের পরামর্শ,মেস বা বাড়ি ভাড়া একমাত্র পথ। কিন্তু দিনের শেষে ওর প্রাণ ভোমরা তিতলির মুখ দেখতে না পেলে সব যেন বৃথা। ভাবলেই মনখারাপের গুড়গুড়।মা মারা যাওয়ার সময় বলেছিলেন,আবার আসিব ফিরে।তারপরই তিতলি এলো ওদের সংসারে।সেই থেকেই তিতলি ওর আর এক 'মা'।সুমনাও খুব খুশি। তিতলি বাড়ির প্রাণ, ভরকেন্দ্র যেন সব কাজের। ওকে ঘিরেই স্বামী স্ত্রীর বাঁচা এখন।
সূর্যের আলো ফুটলেই শুরু হয় অফিসের তোড়জোড় সুমনের। বিছানায় ফেলে আসা ঘুম ও ট্রেনের দীর্ঘ যাত্রায় পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করে।
এতে অফিসে পৌঁছে বেশ তাজা লাগে ওর । ফেরার সময়ও একই দিনলিপি।জানালার ধারে ট্রেনের সিটের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ও এলিয়ে দেয় নিজেকে। নতুন পরিচিতদের সাথে কথোপকথন ও দীর্ঘায়িত করে না।কারণ ওর এই ঘুমটা প্রয়োজন তিতলির জন্য। বাড়ি ফিরলেই তিতলি ছায়াসঙ্গী।বাবাইকে তখন ওর বন্ধু হয়ে লুডো , ক্রিকেট খেলতে হবে। কার্টুন দেখতে বসে ওর অনুকরণে হাসতে হবে।ওর সব আবোলতাবোলে
স্মিত হাসি হতে হবে। সুমনা দশদূর্গা হয়ে সামলায় সব।মেয়ের স্কুল, পড়াশোনা,বাজার একার হাতে করে।কোন অভিযোগ নেই।ও বোঝে সুমনের অবস্থা। বড়ো ভালোলাগা তখন হৃদমাঝারে। ভালোবাসার বৃষ্টিরা পিয়ানোর টুং টাং হয়ে বাজে শরীর জুড়ে। মাঝে মাঝে রবিবার গঙ্গার ঘাটে বসা,ফুচকা খাওয়া অথবা মলে গিয়ে কেনাকাটা। জীবন চলছে এভাবেই পরিণদ্ধ প্রাণের প্রৈতিতে।
সেদিন অফিস ফেরত একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটলো।জানালার ধারের সিটে এলোমেলো হাওয়ার পাগলপণ সামলাচ্ছে আবেশী ভালোলাগায়।বৈদ্য চা দিয়ে চলে গেছে। ফেরার পথে বৈদ্যর চা সত্যিই যেন একটু প্রাণ যোগ করে ক্লান্তিতে। এদিক ওদিক মুচকি হাসির বিনিময় শেষ। এবার শুরু হবে ঘুমের আলপনা আঁকা। হঠাৎ কানে ভেসে এলো ওর সেই প্রিয় গান মাউথ অর্গানের সুরে। তিতলিও গায় গানটা। বলে,দাড়িদাদুর গান।উৎসুক চোখ খুঁজে পেল এক ভিখারি মুখে মাউথ অর্গান ও বুকে একটা বক্স নিয়ে এগিয়ে আসছে। সঙ্গের মহিলাটি হাত পেতে পয়সা চাইছে সকলের কাছে।গানটার কিছু জায়গায় সুরের অসঙ্গতিতে গানের মজাই উধাও। ওর প্রিয় গানের বেসুরো সুর সুমনকে খুব কষ্ট দিতে লাগলো। মনে পড়লো, এই গানটা কতো অনুষ্ঠানে ও বাজিয়েছে। তখন মাউথঅর্গান ছিল ওর পকেট বন্ধু। আস্তে আস্তে জীবিকার চাপে ও তাপে তা আজ শো-কেসে শোভা পায়।
মনের ভেতর ডানা ঝাপটানো শুরু ওর।এক অন্ধ ভিখারি শেষ অবলম্বন করেছে তার প্রাণের ঠাকুরকে।দিক না ও ঠাকুরের গান একটু ঠিক করে! ঠাকুরের আরতি কেন বেসুরো থাকবে?
সুমন ভিখারিকে বসাল ওর পাশে। সঙ্গী ভদ্রমহিলার বিরক্তির ভ্রু কুঞ্চন।সময় নষ্ট হবে ভাবছে।বাজালে পয়সা। হয়তো অনেক কামরায় ঘোরা বাকি।সুমন ভিখারিটার মাউথ অর্গানটা নিয়ে রিডগুলো ঠিক করে দেখিয়ে দিল। শ্বাসের টানা ছাড়া বুঝিয়ে দিল ভালো করে। শ্বাসের বাতাসেই তো মাউথ অর্গান গাইবে আসল সুরে।ও বোঝাতে লাগলো রিড ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে। অনেক টা ব্রেইল পদ্ধতির মতো করে।ভিখারি বুঝলো সব।বাজালো গানটা : "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে/তবে একলা চলো রে"! ঠিক সুরে কেঁপে উঠলো সারা কামরা। একরাশ আনন্দ ওর চোখে মুখে।
যাবার আগে ধন্যবাদ দিতে যেতেই একশো টাকার একটা নোট সুমন ওর হাতে দিল। অনেকটা ভিক্ষার সময় যে নষ্ট হলো ওর! সুমনের মার মুখটা মনে পড়ল। মা বলতেন,"একা লাগলেই এই গানটা গাইবি। মনে শক্তি পাবি ।" মায়ের মুখটা আস্তে আস্তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখে বদলে যেতে লাগলো।মাউথ অর্গানের সুর দূরে মিলিয়ে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে।