বাইশটা বছর কেটে গেলো ,
তোমার একটা ফোনের অপেক্ষায় । অথচ দেখো, মৃত্যুর কতটা কাছে চলে আসার পর
আজকে তোমার জানার ইচ্ছে হলো আমি কেমন আছি ?
মোটা ফ্রেমের চশমা আর হাতে বাজারের ব্যাগ দেখে তুমি ধারণা করে বললে, ব্যাস সংসারী লাগছে আমায় । সংসার তো পাতে মানুষেরা , যেমন করে আমি আর তুমি একদিন সংসারী ছিলাম ।
আজ তোমার সামনে বিধ্বস্তবস্তায় আমাকে দেখে তুমি বলছো, বয়োসের ছাপ আমার শরীরকে কতটা মুড়িয়ে দিয়েছে ?
বয়োস বেড়েছে ঠিকি , কিন্তু সবটুকু দোষ বয়সকেই বা দেই কি করে বলো ?
চশমা ছাড়া পথ চলতে গেলে আজকাল প্রায়ই হুচোট খেয়ে পড়ে যাই । পড়ে দিয়ে আবার পেছনে তাকাই না, নিজে নিজেই উঠে যাই । কারণ আমি জানি হুচট খেয়ে পড়ে গেলে আর কোনো হাত নেই যে আমাকে উঠিয়ে দাড় করাবে।
তবুও কেমন জানি বুকের মধ্যে একটা আশা পুষে রাখি।
আজ অনেকটা বছর পর অন্তত এটা ভেবে ভালো লাগছে , তুমি এখনও আমার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর ঠোঁটের নিচে তিলটার কথা মনে রেখেছ ।
সেদিন যখন তোমাকে রবীন্দ্রনাথের কথা বলতাম , দাড়ি গোঁফ বড় করে রবীন্দ্রনাথ হবো ,সেটা ছিল আদিখ্যেতা, তোমাকে খুনসুটিতে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা ।
জানো, এই বাইশ টা বছর আমার নিঃসঙ্গ রাতগুলো কিভাবে কেটেছে ? টেলিফোন গিয়ে মোবাইল আসলো অথচ আমি কি বাচ্চার মত সেই নব্বই দশকের তারযুক্ত টেলিফোনটাকে জোড়াতালি দিয়ে কেমন চোখে চোখে রেখেছি । শুধু একটা ফোনের অপেক্ষায় আজ বাইশটা বছর কেটে গেলো ।
অথচ তোমার ফোনের শব্দ আমায় কর্ণপাত করেনি।
আমি খুব ভালো নেই অঞ্চিতা ।
অবহেলা অযত্ন আমাকে ভালো রাখেনি এই বাইশটা বছর।
সেদিন যখন তুমি আমাকে দেখলে, আড় চোখে আমিও অনেক্ষন তোমাকে দেখেছি । পাশাপাশি ছিলে অথচ মনে হলো- তুমি কত দূরের তুমি ।
সেদিন বুঝলাম অধিকার থেকে অধিকার হারিয়ে ফেলার মত যন্ত্রণা এই পৃথিবীতে আর কিছুই নেই ।
কতটা বদলে গেছো তুমি এই বাইশ বছরে ।
আজ কতটা অপরিচিত আচরণ তোমার ,অথচ এই বুকে একদিন তোমার ঘর বাড়ি ছিল ।
সেদিন যখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের পথ চলা এখানেই শেষ । তখন আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে বলবে , অনিমেষ তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না ।
আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে পেছন থেকে ফেরাবে। দৌড়ে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে অনিমেষ আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না, প্লিজ তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না । আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না ।
কিন্তু যখন দেখলাম তুমি মরিচবাতির আলোয় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছ , তখন মনে হলো তুমি আমাকে ছাড়া খুব ভালই থাকবে ।
বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরে সরে সেদিন সারারাত টেলিফোনটা বুকে জড়িয়ে শুয়ে ছিলাম ।
তুমি বলেছো, সেদিন তুমি আমার ফোনের অপেক্ষা করেছিলে।
কই একটা বার তো ফোন করে খোঁজ নাও নি ।
কেনো তুমি জানতে না বৃষ্টিতে ভেজার পর আমি কখনো ভালো ছিলাম না ?
জানো ? পাশাপাশি চলার পর যখন একটা মানুষ হঠাৎ একা হয়ে যায়, তখন মনে হয় এই বেচেঁ থাকা আর না থাকার মধ্যে পার্থক্য - কিছুই নেই ।
তবুও কেনো জানি একটা অহেতুক আশা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল , একটা নিভে যাওয়া আলো আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো- দেখিস একদিন আবার এই বুকে আলো জ্বলবে ।
সেদিন যখন তুমি আমার পাশ দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলে -তখন বুঝে নিয়েছি , এই অন্ধকার জীবনে আর আলোর প্রদীপ জ্বলবে না ।
এই চেনা পথ ধরে আর একসাথে পথ চলা হবে না।
বয়স চলে এসেছে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে । অপেক্ষা ফুরিয়ে গেছে আমাদের । তোমাকে আর মৃন্ময়ী নামে ডাকা হলো না।
তোমাকে আর ছুয়ে দেওয়া হলো না । তোমার কলিংবেল আর আমার হাতের স্পর্শ পেলো না ।
অঞ্চিতা , তুমি আর আমাকে ভুল বুঝ না ।
ভালো থেকো অঞ্চিতা , খুব ভালো থেকো ।
বাইশ বছর কেটে গেলো , অথচ তোমার ফোন এলো না
✍🏻_মাহমুদ সোহেল